মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় ৩ দিনের লালন স্মরণোৎসব।
নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনার কারণে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় ২০২০ সালের পরে টানা দুই বছর কুষ্টিয়ায় ছেঁউড়িয়ায় বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্ এর আখড়াবাড়িতে ছিল না লালন স্মরণোৎসব ও লালন তিরোধান দিবসে কোনো আয়োজন। সাধু ভক্তদের মিলন মেলায় করোনার কারণে পড়ে ছিল ভাটা তবে মহামারির সংকট কাটিয়ে এবারে আবারও মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) থেকে শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী লালন স্মরণোৎসব।
এবারে সাংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় তিন দিনের লালন স্মরণোৎসবের আয়োজন করেছে কুষ্টিয়ার লালন একাডেমি। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্ এর এই আধ্যাত্মিক বাণীর স্লোগানে মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) থেকে শুরু হয়ে এ উৎসব চলবে বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) পর্যন্ত।
এ উপলক্ষে কয়েকদিন আগে থেকে আখড়াবাড়িতে হাজার-হাজার ভক্ত-অনুসারীরা দূরদূরান্ত থেকে আসতে শুরু করেছেন। কালীগঙ্গা নদীর পাড় ঘেঁষে লালন মাঠে প্রায় শতাধিক অস্থায়ী বসা-থাকার জায়গা ও প্রায় অর্ধশতাধিক দোকান বসেছে।
বাউল সম্রাট লালন শাহ্ তার জীবদ্দশায় ছেঁউড়িয়ার এই আখড়াবাড়িতে প্রতি বছর চৈত্রের দোল পূর্ণিমা রাতে বাউলদের নিয়ে সাধুসঙ্গ উৎসব করতেন।
১২৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিক তার মৃত্যুর পরও এ উৎসব চালিয়ে আসছেন তার অনুসারীরা। কিন্তু করোনার কারণে দুই বছর বন্ধ ছিল এ আয়োজন। এবার সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় লালন একাডেমি তিন দিনের এ লালন স্মরনোৎসবের আয়োজন করেছে। দুই বছর পরে সাধু ভক্তরা লালন মাজারে আসতে পেরে খুঁশি তারা।
তিন দিনের এ আয়োজনে সাধুদের আনুষ্ঠানিকতার বাইরে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে আয়োজকরা।
উদ্বোধনী দিন থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিট থেকে লালন মুক্তমঞ্চে আলোচনা সভা এবং পরে বাউল গানের আয়োজন করা হয়েছে।
১৫ মার্চ প্রথম দিনের আলোচনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. ইসমাইল হোসেন, এনডিসি।
বুধবার (১৬ মার্চ) দ্বিতীয় দিনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালনের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।
বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) শেষ দিনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মাহাবুব উল আলম হানিফ।
তিন দিনের এই আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও লালন একাডেমির সভাপতি মো. সাইদুল ইসলাম।
সেই সঙ্গে উৎসব চলাকালীন সময়ে প্রতিদিন আলোচনা সভা শেষে দেশ বরেণ্য লালন গানের শিল্পী, লালন একাডেমির শিল্পীসহ গুণী সংগীত শিল্পীরা গান পরিবেশন করবেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, ডিসি সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘তিন দিনব্যাপী এ লালন স্মরণোৎসবকে ঘিরে ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশের পাশাপাশি, র্যপিট অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), সাদা পোশাকে জেলা গোয়েন্দা (ডিসি) পুলিশ এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে থাকবেন।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামের এই আখড়াবাড়িই ছিল বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্ এর প্রধান অবস্থান এবং এখানেই তিনি জীবনের শেষ প্রয়াণ নেন। তবে বর্তমান সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে লালন একাডেমি। এখানে লালন সমাধীস্থলকে স্মরণীয় করতে ১৯৬২ সালে একটি সমাধী সৌধ নির্মিত হয়েছে।
ভক্ত, আশেকান, অনুসারী ও শিষ্যদের মতে, লালন তরুণ বয়সে রোগাক্রান্ত ও অচেতন অবস্থায় ছেঁউড়িয়া গ্রামের কালী গঙ্গার পূর্বপাশের তীরে পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় মলম ফকিরের স্ত্রী মতিজান গ্রামের অন্যদের সাহায্যে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। বাড়িতে এনে অসুস্থ লালনকে সেবা যত্ন করে সুস্থ করে তোলেন। এভাবে সান্নিধ্য লাভের মধ্য দিয়ে মতিজানের স্বামী মলম কবিরাজ নিজেও লালন সাঁইয়ের অনুসারী হয়ে উঠেন।
লালনের গুরু সিরাজ সাইয়ের কাছে দীক্ষা লাভ এবং লালনের কণ্ঠে পবিত্র কোরআন শরীফের শুদ্ধ পাঠ শুনে মলম কবিরাজ, স্ত্রী মতিজানসহ আশপাশের প্রতিবেশীরাও অনুরক্ত হয়ে উঠেন লালনের প্রতি। এই সময়ই লালন কোথাকার কে, কার সন্তান, কোথায় তার জন্ম, কী তার পরিচয় এ নিয়ে শুরু হয় জল্পনা-কল্পনা। তবে এসব প্রশ্নের জবাবে লালন ছিলেন নিশ্চুপ। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও লালন গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে অনীহা প্রকাশ করেন। পরে সিরাজ সাঁইয়ের কাছে দীক্ষা লাভের পর মলম কবিরাজ তার ভূসম্পত্তির একটা অংশ লালনকে লিখে দেন। একইসঙ্গে মলম কবিরাজের অনুরোধ ও গুরু সিরাজ সাঁইয়ের নির্দেশক্রমে লালন এই ছেঁউড়িয়া গ্রামে নির্মিত কুঁড়ে ঘরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন যা আজকের ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়ি নামে পরিচিতি পেয়েছে দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বময়।
লালনের জীবদ্দশায় এক বিধবা নারীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন আখড়াবাড়িতে যিনি পরে লালনের স্ত্রী রূপে এবং বিশাখা নামে পরিচিতি পান। লালন ফকির প্রতি বছর শীতকালে মহোৎসব করতেন, এবং সে উৎসবে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভক্ত আশেকান সাধু বাউল ফকিররা মিলিত হতো। ওই উৎসবকে ঘিরে সেখানে বাউল গানের আসর হতো এবং লালন ও তার স্ত্রী পরিচয়ধারী বিশাখাও সেই জলসায় অংশ নিতেন। সেখানে সব গানই মূলত লালন নিজেই রচনা ও সুর সংযোজন করতেন যা পরে তার শিষ্য-অনুসারীরা রপ্ত করতেন।
লালনের জন্ম সংক্রান্ত তথ্যানুযায়ী সঠিক সময়কাল শনাক্তকরণ সম্ভব না হওয়ায় তিনি জীবদ্দশায় প্রকৃত অর্থে কত বছর বেঁচে ছিলেন তার নির্ণয় করা যায়নি। তবে তিনি যে একজন দীর্ঘায়ু ব্যক্তি হিসেবে বেঁচে ছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই বলে শিষ্য-অনুসারীদের ধারণা।
তৎকালীন কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হিতকারী নামক পাক্ষিক পত্রিকায় লালন ফকিরের তিরোধানের ওপর রচিত সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। ওই সম্পাদকীয় লেখার বিবরণানুযায়ী মৃত্যুকালে লালনের বয়স হয়েছিল ১১৬ বছর। লালন ফকির মৃত্যুকালের এক মাস আগে থেকে পেটের অসুখে পীড়িত হন এবং হাতপায়ের গ্রন্থি জলস্ফীত হয়। পীড়িত অবস্থায় দুধ ভিন্ন অন্য কিছু খান নাই। তবে মাঝে মধ্যে কিঞ্চিত মাছ খেতে পছন্দ করতেন।
লালন ফকির মৃত্যুর পূর্ব রাতেও ভক্ত শিষ্যদের সঙ্গে গান করেছেন এবং ভোর ৫টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। লালন শাহ্ এর ইচ্ছা ও পূর্ব নির্ধারিত ঘরেই তাকে সমাধি করা হয়। মৃত্যুকালে তার কাছে প্রায় ২ হাজার টাকা ছিল। ছেঁউড়িয়াতে তার সমাধির পশ্চিম পাশে মলম সাহের স্ত্রী মতিজানেরও সমাধি রয়েছে। লালন শাহ্’র স্ত্রী বিশাখা স্বামীর মৃত্যুর পর বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন এবং তিনি মৃত্যু বরণ করলে লালন শাহ্ এর সমাধীর দক্ষিণ পাশের তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
লালন ফকির দীর্ঘ সময়কাল ধরে তার নিজস্ব আত্ম দর্শনের আলোকে ভক্ত আশেকান ও শিষ্যদের নিয়ে যে সব উৎসব মুখর কর্মকাণ্ড করতেন তারই ধারাবাহিকতায় আজও পর্যন্ত দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভক্ত-শিষ্য অনুসারীরা পালন করতে বছরের দুইটি দিন যথা দোল উৎসব এবং পহেলা কার্তিক সাঁইজির তিরোধান দিবস পালন করতে মিলিত হয়ে থাকে এই সাধন তীর্থ ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে। এসব উৎসবে লালনের রেখে যাওয়া মানব মুক্তির সহস্রাধিক আধ্যাত্মিক বাণী সম্বলিত গান গাওয়া হয়। সেইসঙ্গে আখড়াবাড়ি সংলগ্ন কালী গঙ্গা মাঠে বসে উৎসবমুখর গ্রামীণ মেলা।
এদিকে, লালন একাডেমির সদস্য সচিব ও সহকারী কমিশনার সবুজ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, লালন স্মরণোৎসবকে কেন্দ্র করে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এ উপলক্ষে মাজার প্রাঙ্গণ ও তার আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পুরো মাজার এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে। জেলা পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবে। সেইসঙ্গে আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা সেখানে দায়িত্বে থাকবেন।