পাবনায় পাঁচ মাসে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকার শামুক বিক্রি।
বাকী বিল্লাহ/(সাঁথিয়া-বেড়া) পাবনা প্রতিনিধি:
চলনবিল, বিল গাজনা, বিল গ্যারকা, ঘুঘুদহ বিল অধ্যুষিত পাবনার বিভিন্ন এলাকার অন্তত দশ হাজার মানুষ শামুক কুড়িয়ে বাড়তি উপার্জন করছেন। বর্ষা মৌসুমে কর্মহীন থাকায় তারা এ কাজের মাধ্যমে কিছু আয়ের মুখ দেখছেন”।
“তাদের কুড়ানো শামুক যাচ্ছে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন চিংড়িঘেরে। জেলা মৎস্য বিভাগ বলছে, বিল এলাকা বলে পাবনায় শামুকের প্রাচুর্য রয়েছে। মাছ বা হাঁসের খাদ্য হিসেবে শামুক ব্যবহার হয়। তবে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সমূলে না কুড়িয়ে পরিমিত পরিমাণে শামুক সংগ্রহ করা উচিত”।
“পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার শামুক ব্যবসায়ীদের মহাজন খান মাহমুদপুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মজিদ জানান, তিনি পঁচিশ বছর ধরে শামুকের ব্যবসা করছেন। পঁচিশ বছর আগে খুলনা থেকে চিংড়িঘের মালিকরা এসে তাদের সাথে চুক্তি করেছিলেন। সেই থেকেই মৌসুমি ব্যবসা করে আসছেন বলে জানান”।
“এখন তিনি প্রতি মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকার শামুক কিনে বিভিন্ন চিংড়িঘেরে পাঠান। তিনি জানান, তার মতো বেশকিছু মহাজনের পাশাপাশি পাবনার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় চারশো ফরিয়া ব্যবসায়ী রয়েছেন। ফরিয়ারা শামুক সংগ্রহ করে তাদের কাছে বিক্রি করেন। ফরিয়াদের অধীনে শামুক সংগ্রহকারীর হিসাব করলে অন্তত দশ হাজার লোক শামুক কুড়ায় বলে তিনি জানান”।
“আব্দুল মজিদ জানান, তাদের মতো বড় ব্যবসায়ীরা শামুক সংগ্রহ করে ট্রাকযোগে এক সাথে দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়িঘের এলাকা সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনায় পাঠান। তিনি জানান, পাবনার সাঁথিয়া, বনগ্রাম, পাবনা সদরের কুচিয়ামারা, বাগচিপাড়া, ফরিদুপর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে, চাটমোহর, ঈশ্বরদীর মূলাডুলি, রাজাপুর, গোপালপুর, চান্দাই, দাসগ্রাম, কদিমচিলান, আটঘড়িয়া, গড়মাটি, মাঝগ্রাম, কাছিমপুর, রামনাথপুর, মহেশ্বর কুজিপুকুর, কলসনগর, আটঘরিয়া উপজেলার ডিকশি বিল, ভাঙ্গুড়া উপজেলার সোনাগাদনের বড় বিল, ভেড়ামারাসহ বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী আড়ত স্থাপিত হয়েছে”।
“তিনি আরো জানান, পাবনা থেকে প্রতিদিন চারটি ট্রাকে এক হাজার বস্তা শামুক খুলনা অঞ্চলে চালান করা হয়। প্রতিটি ট্রাকে আড়াই শত বস্তা শামুক থাকে। হিসাব মতে পাবনা জেলা থেকে প্রতিদিন চার লাখ টাকার শামুক চালান হয় দক্ষিণাঞ্চলে। সে হিসেবে পাবনা থেকে পাঁচ মাসে অন্তত পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকার শামুক সরবরাহ হয়”।
“তিনি জানান, শামুকের আকারভেদে তারা প্রতি বস্তা আড়াইশো থেকে তিনশো পঞ্চাশ টাকায় কেনেন। এর মধ্যে বস্তা কেনা, লেবার খরচ দিয়ে চারশো টাকা প্রতি বস্তা দাম পড়ে। এরপর ট্রাক ভাড়া, শ্রমিক খরচ, খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে তাদের বস্তাপ্রতি বিশ থেকে ত্রিশ টাকা লাভ থাকে”।
“শামুক ব্যবসায়ী আব্দুল মজিদ আরও জানান, আষাঢ় মাস থেকে শুরু করে কার্তিক মাস পর্যন্ত শামুক কুড়ানো ও সরবরাহ চালু থাকে। তিনি জানান, ফরিয়াদের সাথে তাদের আগেই চুক্তি হয় শামুক সরবরাহের ব্যাপারে। ফরিয়ারা স্থানীয় লোকজন চুক্তিবদ্ধ করেন। তারা সারাদিন শামুক কুড়িয়ে ফরিয়াদের কাছে বিক্রি করেন”।
“সাঁথিয়া উপজেলার গৌরিগ্রামের বাসিন্দা (ফরিয়া) নূর ইসলাম জানান, তিনি আঠারো বছর ধরে শামুকের ব্যবসার সাথে জড়িত। তিনি সাঁথিয়া উপজেলার বড় বিল, ছোট বিল, মটকা বিল এলাকার শামুক কেনেন। তার অধীনে বিশ থেকে পঁচিশ জন শামুক কুড়ানি আছেন। তার মতো সব ফরিয়াই শামুক কুড়ানিদের ডিঙি নৌকা কিনে দিয়েছেন”।
“বিল গ্যারকা পাড়ে গিয়ে কয়েকজন শামুক কুড়ানো শ্রমিকের সাথে কথা হয়। তাদের একজন আব্দুল কাদের (৫৫) জানান, রাত তিনটায় ডিঙি নৌকা নিয়ে শামুক কুড়ানোর জন্য বের হন। দুপুর নাগাদ ফিরে আসেন। এতে দেড় বস্তা শামুক সংগ্রহ করতে পারেন। শামুক সংগ্রকারীরা জানান, এসময় তাদের হাতে তেমন কাজ থাকে না। এ সময় তারা শামুক কুড়িয়ে কিছু অর্থ উপার্জন করেন”।
“বিল গ্যারকা এলাকার ফরিয়া সাহেব আলী জানান, তিনি গ্যারকা বিলে বিশ থেকে পঁচিশ জন শামুক কুড়ানিকে চুক্তিবদ্ধ করেছেন। তারা তার কাছে শামুক বিক্রি করেন। তিনি এ শামুক ভ্যানযোগে মহাসড়কে মহাজনের কাছে পৌঁছে দেন। তিনি জানান, বর্ষাকালের কিছুটা কর্মহীন থাকায় এ কাজে অনেকেই এগিয়ে আসেন। তিনি লাভবান হচ্ছেন এর পাশাপাশি অনেক গরিব মানুষও লাভবান হচ্ছে”।
“পাবনার সাঁথিয়ার ভ্যানচালক রানা জানান, শামুক পরিবহনে তিনি লাভবান হচ্ছেন। এ উপজেলায় তার মতো আরও অর্ধ-শতাধিক ভ্যানচালক রয়েছেন। তারা প্রতি বস্তা শামুক পরিবহনে পান পঁচিশ টাকা। প্রতিটি ট্রিপে তিনি পনেরো থেকে আঠারো বস্তা শামুক আনেন বলে জানান। বছরের কয়েক মাস তাদের ভালো আয় রোজগার হয়”।
“ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলি বাজারে শামুক বিক্রির বড় আড়ত গড়ে উঠেছে। এখানে প্রতিদিন দুইশো থেকে তিনশো বস্তা শামুক সংগ্রহ করেন মহাজনরা। এখানে এক শামুক সংগ্রহকারী (শামুক কুড়ানি) রমজান শেখ জানান, বর্ষার সময় চাষাবাদ বন্ধ থাকে বলে তাদের হাতে কাজ থাকে না। তাই পেটের দায়ে তারা স্থানীয় শামুক ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় শামুক সংগ্রহ করেন। শামুক সংগ্রহ করে প্রতিদিন জনপ্রতি চারশো থেকে পাঁচশো টাকা আয় হয়”।
“ঈশ্বরদীর শামুক ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম জানান, ঈশ্বরদীর আড়ত থেকে কিনে তারা সেই শামুক খুলনা অঞ্চলে নিয়ে বিক্রি করেন। প্রতি বস্তায় বিশ থেকে ত্রিশ টাকা করে লাভ থাকে। একজন শামুক কুড়ানো শ্রমিক গড়ে প্রতিদিন চারশো থেকে পাঁচশো টাকার শামুক কুড়াতে পারেন”।
“স্থানীয় শামুক ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম, দুলাল উদ্দিন জানান, তারা শামুক কিনে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়িঘের এলাকা সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনায় সরবরাহ করেন। ঈশ্বরদীতে শামুকের আড়তদার আশরাফ শেখ জানান, ঈশ্বরদী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজন প্রতিদিন কয়েকশত বস্তা শামুক তাদের কাছে বিক্রি করেন। এসব এলাকার বহু মানুষ শামুক কুড়ানোকে তাদের মৌসুমি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন”।
“ব্যবসায়ীরা জানান, এই শামুক ব্যবসা ঈশ্বরদীতে প্রায় এক যুগ ধরে ধরে চলে আসছে। স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুস সামাদ জানান, শামুক কুড়িয়ে এ এলাকার অনেক মানুষ এখন বাড়তি কিছু টাকা আয় করছেন”।
“এ ব্যাপারে পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তোজাম্মেল হোসেন বলেন, উন্মুক্ত জলাশয়ের বিশেষ করে খাল, বিল, হাওর, বাঁওড়ে বংশ বিস্তার করে থাকে শামুক ও ঝিনুক। জলাশয়ের নোংরা পানির পোকামাকড় খেয়ে পানি বিশুদ্ধকরণের কাজ করে তারা। শামুক এবং ঝিনুক চাষির বন্ধু। এ প্রাণীটি নীরবেই আমাদের উপকার করছে। বর্ষার শেষে পানি কমার সাথে সাথে এ প্রাণী গুলোর বেশিরভাগ মারা যায়। তখন শামুক এবং ঝিনুক কৃষি জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে”।
“পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, পাবনা বিল অধ্যুষিত জেলা। এ জেলায় প্রচুর শামুক ঝিনুক হয়। সাধারণত এখন কেউ ঝিনুক কুড়ায় না। শামুক কুড়ানো হয়। এতে অনেক দরিদ্র মানুষ বর্ষার কয়েক মাস বাড়তি কিছু টাকা আয় করেন”।
“শামুক যেহেতু পরিবেশ ও কৃষিবান্ধব তাই শামুক সংগ্রহে সবার সতর্ক থাকা দরকার। সম্পূর্ণ বিল এলাকার শামুক উজাড় না করে স্বল্প পরিমাণে শামুক ধরা উচিত। এতে জীব বৈচিত্র্য রক্ষা পাবে বলে তিনি জানান”।